গৃহকর্মীদের ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতন দিন দিন উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে রাজধানীতে গৃহকর্মীর উপর নীপিড়ন-নির্যাতন আশংকাজনক হারে বাড়ছে। বাড়ছে নির্যাতনের মাত্রা,নৃশংসতা ও নির্যাতনে অপমৃত্যুর ঘটনাও। গত জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত মাত্র চার মাসেই রাজধানীর বিভিন্ন বাসা-বাড়ি থেকে শতাধিক গৃহকর্মীর মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। গৃহকর্মীদের শরীরে আগুনের ছেঁকা দেয়ার ক্ষতের চিহ্ন পত্র-পত্রিকায় প্রায়ই দৃষ্টিগোচর হয়। যারা এভাবে পেটে ভাতে মানুষের বাসায় কাজ করতে আসে তারা দরিদ্র, অশিক্ষিত। অশিক্ষিত বলে অনেক কিছুর ভালমন্দ বুঝে উঠতে পারেনা। আর একারণেই মানুষের বাসায় কাজ কর
তে এসে নানা অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার হয়। বলা বাহুল্য, এসব গৃহকর্মীর বেশির ভাগই অভাব-তাড়িত হয়ে গ্রাম থেকে রাজধানীতে আসে দুবেলা-দুমুঠো খাবারের সন্ধানে। এইসব গৃহকর্মীরা ঢাকায় এসে অচেনা-অপরিচিত পরিবেশে নির্যাতনের অভিযোগ কোথায় কীভাবে করতে হতে তা জানেন না। একারণে নির্যাতন মুখ বুজে সহ্য করে যাওয়া ছাড়া কোনো পথ খোলা থাকে না। তাই বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এসব নির্যাতনের খবর রয়ে যায় লোকচুক্ষর আড়ালে। তাদের এই অসহায়ত্বের সুযোগ পেয়ে রাজধানীর উঁচু তলার মানুষেরা তাদের উপর অকথ্য নির্যাতন করে থাকেন।
বাংলাদেশ মানবাধিকার বাসত্মবায়ন সংস্থায় জরিপে বলা হয়েছে, ২০১০ সালে নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা যায় ৪৫ গৃহকর্মী। আহত হয়েছে প্রায় ৩৪ জন। চলতি ২০১১ সালের জানুয়ারি থেকে মধ্য সেপ্টেম্বর নাগাদ ২৭ গৃহকর্মীর মৃতু্য ঘটেছে। আহত হয়েছে ৩১ জন। ২০১২ সালের আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যানুযায়ী ১২০ জন গৃহকর্মী মেয়েশিশু নির্যাতনের শিকার। তন্মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৭ জন। হত্যা করা হয়েছে ১৭ জনকে যাদের বয়স ১৩ থেকে ১৮ শারীরিক নির্যাতনের শিকার ৪৬ জন। শারীরিক নির্যাতনের পর হত্যা করা হয়েছে ৩ জনকে যাদের বয়স ৭ থেকে ১২ বছর। আত্মহত্যা করেছে ২০ জন। শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে ১ জনকে। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছে ১ জন। বাংলাদেশ মানবাধিকার বাসত্মবায়ন সংস্থাটি মাসওয়ারি মৃত্যু ও আহত হওয়ার পরিসংখ্যানও বের করেছে। জানা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ৩ জন গৃহকর্মীর মৃতু্য হয়েছে নির্যাতনের কারণে। আহত হয়েছে ১ জন। ফেব্রম্নয়ারিতে ৬ জন গৃহকর্মীর মৃতু্য হয়েছে। আহতদের সংখ্যা ৪ জন। মার্চ মাসে নিহত ও আহতের সংখ্যা যথাক্রমে ২ ও ৫ জন। এপ্রিল মাসে ৫ জন গৃহকর্মীর মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছে ৬ জন গৃহকর্মী। মে মাসে নিহত ও আহতের সংখ্যা যথাক্রমে ৩ জন এবং ২ জন। জুনে নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা গেছে ১ জন। আর আহত হয়েছে ৩ জন। জুলাই মাসে নির্যাতনের কারণে আহত ও নিহত হয়েছে যথাক্রমে ৩ জন এবং ২ জন। আগস্ট মাসে নিহত ও আহতের সংখ্যা ২ জন এবং ৭ জন। সেপ্টেম্বর মাসের ১৫ তারিখ পর্যন্ত নির্যাতনের ঘটনায় নিহত হয়েছে ২ জন গৃহকর্মী। আর আত্মহত্যা করেছে একজন। অনেকে এটাও বলছেন, গৃহকর্তা-গৃহকর্ত্রী বা তাদের লোকদের অত্যাচারে আরও বেশি গৃহকর্মীর মৃত্যু ও আহত হতে পারে। কারণ এ ধরনের সব খবর নানা কারণে সব সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের কাছে পৌঁছেনা। বাংলাদেশ চাইল্ড রাইটস ফাউন্ডেশনের একটি সূত্রে বলা হয়েছে, রাজধানীতে গৃহকর্মীর সংখ্যা প্রায় দেড় লাখ। এদের মধ্যে পাঁচ থেকে ১৫ বছর বয়সী মেয়েদের সংখ্যা বেশি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গৃহকর্মীদের এমন পরিণতির আরেক কারণ আইনী সুরক্ষার অভাব। তাদের জন্য নেই কোন শ্রম আইন, নেই মজুরি গেজেট ও আচরণবিধি। এ জন্য নিশ্চিত করতে হবে জাতীয় নীতিমালাও ও ন্যূনতম মজুরি বোর্ড গঠন। তাদের জন্য নিশ্চিত করতে হবে দৈনিক বিশ্রাম, সাপ্তাহিক ছুটি ইত্যাদি। পাশাপাশি স্বাস্থ্য, শিৰা ও বিনোদনের সুযোগও নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ বলেছে, শতকরা প্রায় ৬৭ ভাগ গৃহকর্মী শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত। চিত্ত বিনোদনের সুযোগ পায় না প্রায় ৫৩ ভাগ গৃহকর্মী। কাজের সময় তিরস্কার বা বকাঝকার শিকার হয় প্রায় ৮৩ শতাংশ। প্রতিনিয়ত কাজ থেকে বাদ দেয়ার হুমকি দেয়া হয় প্রায় ৪৭ শতাংশ গৃহকর্মীকে। সামর্থ্যের অতিরিক্ত কাজ করে প্রায় ৬৪ শতাংশ। যৌন নিপীড়নের শিকার হয় প্রায় ১৭ শতাংশ গৃহকর্মী। নিরাপত্তাহীনতা ও মানসিক হতাশায় ভোগে যথাক্রমে প্রায় ৪০ শতাংশ এবং ৬৮ শতাংশ। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের একটি সূত্রে বলা হয়েছে, গৃহকর্মীরা নির্যাতনের শিকার হয় পশ্চাৎপদ সমাজ ব্যবস্থা ও পুরম্নষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে। দরিদ্রতাও একটি বড় কারণ। জানা গেছে, গৃহকর্মীদের জন্য চলছে একটি নীতিমালা তৈরির প্রক্রিয়া। সেখানে অন্তরভুক্ত করা হয়েছে তাদের মজুরি ও সাপ্তাহিক ছুটিসহ অন্যান্য বিষয়।
তবে এটাও ঠিক যে অনেক গৃহকর্তা-গৃহকর্ত্রী তাদের গৃহকর্মীদের সাথে নম্র ব্যবহার করে এবং তাদের দেখভাল করে সযত্নে। অনেকে গৃহকর্মীর পরিবারের খোঁজ খবর নেন এবং ভাল বিয়েও দেন। তবে এই শ্রেণীর মানুষের সংখ্যা হাতে গোনা। অথচ এটা খুবই স্বাভাবিক যে কাউকে গৃহকর্মী হিসেবে কাজে লাগালে তার প্রতি কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্যের বিষয় এমনিতেই চলে আসে। এসব যেমন আমাদের মেনে চলা উচিত তেমনি তাদের প্রতি খারাপ আচরণ বা নির্যাতন করার কোন অধিকার আমাদের নেই এবং তা দণ্ডনীয় অপরাধও বটে। হোক না সে গৃহকর্মী তার প্রতি নিশ্চয়ই ভালো আচরণ করা উচিত। তারাও মানুষ, আর তাই তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করা আমাদের মনুষ্যত্বেরই বহিঃপ্রকাশ।আমাদের মনন মানসিকতায় যদি আমরা উন্নত না হই, প্রতিটি মানুষকে মানুষ হিসাবে মূল্যায়িত না করে- সে গৃহকর্মী, আমি মালিক এই ধরণের মানসিকতা পরিহার করতে না পারি তাহলে আমরা মানুষ হই কিভাবে? মনুষ্যত্ববোধ থাকলে তবেই না তাকে মানুষ হিসেবে গণ্য করা হয়। নির্যাতিত হয়ে অনেক গৃহকর্মী নিজের অজানত্মেই খারাপের দিকে পা বাড়াতে পারে। অতএব, এমন পরিবেশ-পরিস্থিতি সৃষ্টি করা উচিত নয় যাতে তারা খারাপ বা অন্ধকার পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়। কেননা এসবের প্রভাব পড়ে পরিবার ও সমাজের ওপরও। তাদের সঙ্গে সবার এমন আচরণ করা উচিত। এতে গৃহকর্মীরা ভাল কিছু শিখবে।আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, গৃহকর্মীরা আমাদের সমাজেরই। তাদের প্রতি আমাদের সদয় আচরণ করা উচিত